একমাত্র সিভিলিয়ান কমান্ড্যান্ট মুক্তিযোদ্ধা মানিক চৌধুরী
ফারাহ পুষ্পিতা
শ্রদ্ধেয় মানিক চৌধুরী ছিলেন একমাত্র সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা যিনি ”কমান্ড্যান্ট’ উপাধি অর্জন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে । তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি নির্দেশনাকে তার জীবনের লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেছিলেন। আর এই নির্দেশনাকে বাস্তবায়িত করতে তার নির্বাচনী এলাকায় যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
হবিগঞ্জে ১৯৩৩ সালে ২০ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া মানিক চৌধুরী, দ্বিধাহীন চিত্তের এই দেশ প্রেমিক ছিলেন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বঙ্গবন্ধুর এক অকুতভয় আদর্শিক সৈনিক।এই বীরযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও সংগঠিত করেন ।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন দিল-খোলা, হাস্য-উজ্জ্বল, বন্ধুসুলভ পরোপকারী একজন মানুষ। রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা করাই ছিল তার আরাধনা । মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি ভূমিকাতেই যিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই মানিক চৌধুরী তার নির্বাচনী এলাকার (চুনারঘাট, শ্রীমঙ্গল ও বাহুবল) সবগুলো চা বাগানের চা শ্রমিকদের নিয়ে একটি শক্তিশালী তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করেন। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে (ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে) পাওয়া তারবার্তা (যাকে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বলা হয়) গ্রহণ করেন তিনি। তিনি সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুত হতে হবিগঞ্জের অন্য নেতা-কর্মীদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করে। একটি দক্ষ সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে যে অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল তিনি তা বুঝতে পারেন ও ২৭ মার্চ দুপুরের কোন এক সময়ে তার নেতৃত্বে ৩৩০টি রাইফেল ও ২২০০ গুলি লুট হয় সিলেট জেলার হবিগঞ্জ সরকারি অস্ত্রাগার থেকে ।
তিনি এপ্রিলের প্রথম দিকে সরাসরি সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও বড় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত শেরপুর সাদিপুর যুদ্ধে অংশ নেয়ার পাশাপাশি ৩ নং, ৪ নং সেক্টর, সেক্টরে সৈন্য, অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহসহ ভারতের খাৈয়াই ও কৈলাশহরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের কাজেও দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেছেন। মানিক চৌধুরী একাধারে যেমন একজন সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন, তেমনি তার এ বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সহকারী চীফ-অব স্টাফ মেজর জেনারেল এম, এ রব হবিগঞ্জ বি,ডি হল প্রঙ্গনে এক বিশাল মুক্তি সংগ্রানি মানুষের সমাবেশে মানিক চৌধুরীকে ‘কমান্ড্যান্ট’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
তিনি , ৬ দফা আন্দোলন , ভাষা আন্দোলন , ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ও বাংলাদেশের স্বাধীনটার যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং তার চাপেই মেজর সি ,আর,দত্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হউন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে হবিগঞ্জ থেকে এম.এন.এ. এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সিলেট – ১৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, ১৭ জুলাই ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশাল সরকারের হবিগঞ্জ মহকুমার গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় আহবায়ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদের জন্য মানিক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে চার বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।
মানিক চৌধুরীর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রচিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে তিনি দেশকে সোনার বাংলা গড়ার কাজে নেমে যান। ৭৩-এ তার নির্বাচনী এলাকা মাধবপুর বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের মডেল হিসাবে নির্বাচিত হয়। যার জন্য তিনি ৭৪-এ বঙ্গবন্ধু কৃষিপদক পান এবং তার এই কর্মের উপর ডক্টর মহাম্মাদ ইউনুস গবেষনা মুলুক কাজ করেন। তিনি হবিগঞ্জ মহকুমার গর্ভনরও নিযুক্ত হন।
১৬ই ডিসেম্বর বীরের বেশে ফেরা মানিক চৌধুরীর বামপকেটে রাখা ভাজ করা “স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি” সম্পর্কে বলেছিলেন , “বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা ছিল আমার জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য। তাই প্রতিটি মুহুর্তে তার এই বার্তা আমাকে শক্তি জোগিয়েছে। শত্রুর বুকে অস্ত্র ধরতে নির্ভিক রেখেছে। অবিচল রেখেছে যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করতে আমাকে। এই বার্তার শক্তি কতটুকু তা আমি যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতি মুহুর্তে অনুভব করেছি। আমি বিশ্বাস করতাম, যদি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদও হতাম। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এই পত্রটিকে আমি ব্যর্থ হতে দিতাম না। জীবন দিয়ে, আমার শরীরের রক্ত দিয়ে ভিজিয়ে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মান আমি সমুন্নত রাখতাম।”
স্বাধীনতার পর মানিক চৌধুরীর কণ্ঠে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা ফুটে উঠেছে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, নানান রাজনৈতিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েও দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৯০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তার জীবনের শেষ বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “একদিন কম্পন হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হবে, দেশের মাটিতেই যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে”।
তিনি ১৯৭৪ সালে ”শ্যামল” প্রকল্পের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নিকট থেকে “বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক” গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ২০১৫ সালের “মরণোত্তর” স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এই মহান পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে পিজি হাসপাতালে ১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সুত্র, ইউকেপিডিয়া ও বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাধর্মী বই থেকে ।
ছবিতেঃ- কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী (বামে) মুক্তিযুদ্ধের সহ সর্বাধিনায়ক জেঃ এম,এ রব এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেঃ এম,এ জি ওসমানী।