মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তরুনপ্রজন্মের ভাবনা
বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি।আসেনি সহজভাবে।কিভাবে আসলো,কোথা থেকে এর উৎপত্তি এর পরিসরে রয়েছে দীর্ঘ ও গৌরবান্বিত ইতিহাস।যে ইতিহাস সত্যিকার অর্থে জানা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করা তরুন প্রজন্মের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
হাজার বছরের গৌরবগাঁথা ঐতিহ্যের দেশ,সবুজের দেশ বাংলাদেশ।স্মরণাতীত কাল থেকেই প্রিয় বাংলাদেশ ছিল পরাধীন।বাঙালীরা শোষিত ও বঞ্চনার শিকার।তারও পূর্বে দু’শ বছর ধরে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছিল এ জাতি।এরপর ১৯৪৭ সালে কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ধর্মভিত্তিক ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে জন্ম হয় স্বাধীন পাকিস্তানের।বাংলাদেশ এখান থেকেই পূর্ব পাকিস্তান নামে স্বাধীন পাকিস্তানেরই একটি অংশ।ফের ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানী শাসকদের শৃংখলে বন্দিত্ব বরণ করল বাঙালী জাতি।এরপর শুরু হলো পশ্চিমা পাকিস্তানী ডিরেক্টরিগণের বাংলা ভাষা নিয়ে বিরোধিতা।যেখান থেকে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি।এ আন্দোলন ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে মুক্তির পথ খুঁজছিল বাঙালী জাতি।সবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু।তার পূর্বে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে কারাগারে আটকে রাখা হয়।কিন্তু গণ আন্দোলনের মুখে তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয় নি।১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবর রহমান সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের ছেড়ে দেয়া হয়।১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ।কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।শুরু করে টালবাহানা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী।১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পুরো জাতিকে একযোগে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান।মুক্তির সংগ্রামে “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বাঙালী জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করেন।সারা বাঙলায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।আপোষ আন্দোলনের নামে কালক্ষেপ করে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে সৈন্য ও অস্রশস্ত্র এনে শক্তি বৃদ্ধি করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।এরপর আসে ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালোরাত। যে রাতকে সম্প্রতি গণহত্যা দিবস বলে ঘোষনা দেয়া হয়েছে।এছাড়া অপারেশন সার্চলাইট নামেও পরিচিত ভয়াল এই রাত। অন্ধকার সেই রাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, ইপিআর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চলে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ।এরপর ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রামের কালুর ঘাট)থেকে তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র পাঠ করেন এবং মুক্তির সংগ্রাম ঘোষনা করেন।পাকবাহিনী তখন আরো বেশী মরিয়া হয়ে ওঠে এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।এরপর বাঙালী দলে দলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়।শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।বিশাল শত্রু বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষন নিয়েও মুক্তিবাহিনীর মোকাবিলায় সক্ষম হয়নি।কারন মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের শক্তিশালী রীতি অবলম্বন করে শত্রুদের বিপর্যস্ত বা পরাস্ত করেছিল।যা গেরিলা যুদ্ধ নামেও পরিচিত।এভাবে নয়টা মাস ধরে চলেছিল মুক্তিযুদ্ধ।পাকিস্তানীদের আক্রমণ ক্রমান্বয়ে দূর্বল হয়ে পড়ে,বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।পরিশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে তারা নিঃশর্তভাবে আত্মসম্পর্ন করে।কিন্তু নয় মাসের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে নির্মমভাবে।শত সহস্র মা বোন হারিয়েছে তাদের সম্ভ্রম। এভাবে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা লাখো শহীদের বিনিময়ে।কাজেই অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী হওয়ার শক্তি ও প্রেরনা তরুন প্রজন্ম পেতে পারে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকেই।তরুনপ্রজন্মের তাই অনেক দায়িত্ব এই স্বাধীনতাকে ধরে রাখার।যে স্বপ্ন ও আকাক্ষা নিয়ে এ দেশে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা তা নানা কারনে বিঘ্নিত হচ্ছে।স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভুত্থান,হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী দেশী ও বিদেশীদের নানা চক্রান্ত ও তৎপরতা,অর্থনৈতিক বৈষম্য,বেকারত্ব,যুব সমাজের মাঝে সৃষ্ট হতাশা,মাদকদ্রব্যে আসক্ত,চোরাচালান ও নানা অপকর্মে লিপ্ত।এছাড়া অতিরিক্ত জনস্ফীতি,আইন শৃংখলার অবনতি,ঘুষ,দূর্নীতি,অপহরন ও চাঁদাবাজি,জঙ্গী তৎপরতা,অপসংস্কৃতি ইত্যাদি সামাজিক অবক্ষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে তুলছে।তরুন সমাজের মাঝে দেখা দেয় বিস্ময় ও তীব্র হতাশা।যখন নতুন চেতনার আলোকউজ্জ্বলতায় তাদেরকে উজ্জীবিত করার কোন পরিকল্পনা থাকে না,থাকে না কোন অাদর্শ।দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বহু কার্যকলাপ বারবার সংঘঠিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে।এমনকি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবার তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার থেকে আজো বঞ্চিত।ঘরে বাইরে সবখানে মনুষ্যত্বের দৈনতার চিত্র।অনুপ্রাণিত করার মতো মহৎ প্রাণ মানুষের বড় অভাব।সমাজে সমাজ বিরোধীর যে সম্মান,যে প্রতিপত্তি,সেখানে সৎ ও জ্ঞানী মানুষের মুল্য তুচ্ছ জ্ঞান করা হয় প্রায়শই। সততা সেখানে লাঞ্চিত,অসহায়।বিবেক সেখানে বর্জিত।জ্ঞানীগুনীরাও তাদের তোষামদ বা খাতির করছে।রাজনৈতিকদের ডান হাত তারা।জঘন্য ও নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ।ধর্মীয় ও মানবিক মুল্যবোধের অভাবেও তরুনদের মাঝে বিস্তৃত করেছে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া।কাজেই তরুনসমাজকে বিপথগামী করার এসব মূল উপকরণই যথেষ্ট ও সদা-তৎপর।
কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করে,তা সাফল্য উদ্ভাসিত করার কৌশল সদা সর্বদা রপ্ত করতে হবে।অধিকার আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা নিয়ে আত্নসচেতনতা বাড়াতে হবে,দেশ গড়ার তাগিদে।সকল অন্ধকারকে শেকড় সহ উৎপাটন করে,মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে নানা উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড ও দেশ প্রেমী চেতনায়।এ দেশের ছাত্র সমাজ,আপামর জনতা সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের অবদান ও লক্ষ্যসমূহ জাগ্রত করার স্থির ও সুদৃর সংকল্প গ্রহন করা অত্যাবশক।সমগ্র জাতির মাঝে দেশপ্রেম ও একতা প্রবল হয়ে উঠলে আমরা সবাই আবার সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রিয় স্বদেশ গড়ার কাজে সংঘবদ্ধ হতে পারবো।এভাবে সমাজে অপরাধকর্ম গুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করাও কঠিন হবে না।দেশ ও জাতি গড়ার প্রত্যয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন জাগ্রত হবে এভাবেই তরুনদের বুকে।এ লক্ষ্যগুলো জাগ্রত করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা যত দ্রুত নেয়া হবে ততোই দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গৌরবময়ের চূড়ান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হবে বলেই বিশ্বাস।
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা-১২০৬
(এই লেখাটি জাতীয় দৈনিক,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের রচনা এবং ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সরবরাহ করে লিখেছি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আমার ভাবনা।ধন্যবাদ)